“অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১০০ দিনের আমলনামা: একটি পর্যালোচনা”

ক. শুরু কথা: গত ১৫ বছর ধরে জাতির ঘাড়ে চেপে বসা জুলুমবাজ সরকারের শাসনামলে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সব প্রতিষ্ঠান যখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে তখনই ছাত্র-জনতার স্বতস্ফুর্ত রক্তঝরা এক আন্দোলনে স্বৈরশাসন বিদায় নিতে বাধ্য হয়। একক কোনো রাজনৈতিক দল বা ভাবাদর্শের অনুসারীরা স্বৈরশাসন হটানোর জন্য এই আন্দোলন গড়ে তোলেনি। এই আন্দোলন সংগঠিত করেছে আমাদের সন্তানরা। তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে আন্দোণকে পরিণতির দিকে নিয়ে গেছে কর্তৃত্ববাদবিরোধী স্বাধিকারকামী সব ছাত্র-ছাত্রী। আওয়ামী লীগ বাদে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা এই আন্দোলনে অংশ নেয়। এই আন্দোলন দমন করতে কর্তৃত্ববাদী সরকারের বিভিন্ন বাহিনী আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি করে। এতে সহ¯্রাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। আহত ও পঙ্গু হয় প্রায় ২২ সহ¯্রাধিক শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ। এই সংঘাতে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভেঙ্গে পড়ে। কারফিউ অমান্য করে গণভবনের দিকে ছুটে আসা ছাত্র-জনতার ঢল ঠেকাতে আরো গুলি চালানোর বিষয়ে সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব অপারগতা প্রকাশ করে। এতে শেখ হাসিনা শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। স্বৈরাচারের পতনের পর সৃষ্ট শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। এ সময় রাজপথের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে ছাত্র-ছাত্রীদের রাস্তায় নামতে হয়। সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিধানে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা নিয়ে মাঠে নামে। শেখ হাসিনার পলায়নের তিন দিন পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার গঠন হয়। এক দফা সম্প্রসারণের পর উপদেষ্টা পরিষদ পূর্ণ অবয়ব লাভ করে। সরকারের সামনে তাৎক্ষণিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় ভেঙেপড়া প্রশাসনকে আবার কার্যকর করা। বিশেষত পুলিশ বাহিনীকে আইন শৃঙ্খলার দায়িত্বে ফেরানো, ক্ষত-বিক্ষত অবকাঠামো মেরামত করে আবার কাজ করার মতো অবস্থায় নিয়ে আসা, জনপ্রশাসনে কর্তৃত্ববাদিতার কাঠামোকে স্বাভাবিক পেশাদার কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণে ফেরানোও ছিল চ্যালেঞ্জ। আরেকটি চ্যালেঞ্জ ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলো সচল করে শিক্ষার্থীদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরানো। রাষ্ট্রের মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে তাৎক্ষণিক পরিবর্তন এনে অবক্ষয় রোধ এবং নতুন যাত্রার জন্য প্রস্তুত করাও ছিল সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এসবের পাশাপাশি রাষ্ট্র সংস্কারে পদক্ষেপ নেয়া ছিল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

মোটা দাগে ১০০ দিনের অর্জন সমূহ:
খ. ১: ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলা: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরই দেশের ৬টি জেলায় স্বরণকালের ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির সম্মুখিন হয়। দেশের ছাত্র-জনতা সরকার সম্মিলিতভাবে এবং স্বতস্ফুর্তার সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে বন্যা দূর্গতদের পাশে দাড়িয়ে যান, তাদের জন্য ফান্ড কালেকশন করেন এবং অসহায় মানুষদের নিকট তা পৌছে দেন। মানুষ নিজের দায়িত্ববোধ থেকে তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। ফলে ভয়াবহ যে বিপর্জয় দেখা দেয়ার আশংকা ছিল তা কেটে যায়। মানুষ ধিরে ধিরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।
খ.২: আইন শৃংখলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা: এই সরকার যখন দেশের দায়িত্ব নেয় তখন আইন শৃংখলা পরিস্থিতি একে বারেই ভেঙ্গে পড়ে। দেশের থানা গুলো সব শুন্য। পুলিশ বাহিনী কর্মস্থলে যোগদান করছে না। একটা নাজুক অবস্থার সৃষ্টি হয়। এ সময় শিক্ষার্থীরা রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয় এবং দক্ষতার সাথে তা পালন করে। ধীরে ধীরে রাস্তায় শৃংখলা ফিরে আসে। থানাগুলোর শৃংখলা ফেরাতে রাজনৈতিক দলগুলো এগিয়ে আসে। সরকার পুলিশ বাহিনীকে কাজে যোগদানের জন্য আল্টিমেটাম দেয়। ফলে গণহত্যার সাথে সরাসরি জড়িত ও আওয়ামী ক্যাডার ছাড়া সবায় কাজে যোগদান করে। ছাত্র-জনতা এবং রাজনৈতিক দলগুলো পাশে দাঁড়ায়। এভাবে আস্তে আস্তে আইন শৃংখলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
খ.৩: অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি: লুটপাট, দূর্নীতি, অর্থ পাচার করে বিগত লুটেরা সরকার দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করে দিয়ে যায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়ে ২১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি করে রিজার্ভ পরিস্থিতি উন্নতি করে। রিজার্ভে হাত না দিয়ে ২ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করে। বিশ্ব ব্যাংক, আই এম এফ সহ দাতা গোষ্ঠী প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার ঋন দেয়ার প্রতিশ্রতি দেয়। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি এখন অনেকটাই উন্নতির দিকে।

খ.৪: গার্মেন্টস শিল্পে অস্থিরতা নিরশন: জাতির ঘাড়ে জগদ্দাল পাথরের মতো চেপে থাকা পতিত সরকার ক্ষমতা হারোনোর পর নানা রুপে নানা বর্ণে দেশকে অস্থির করে তোলার ষড়যন্ত্র চলমান রাখে। তারা গার্মেন্টস কর্মিদের মধ্যে ঢুকে গিয়ে জ্বালাও, পোড়াও, ভাংচুর করে এ শিল্পকে অচল করে দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সচেতন ছাত্র সমাজ ও সরকারের আন্তরিকতার কারনে সে চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং গামেন্টস শিল্পে অস্থিরতা অনেকাংশে দূর হয়। শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনের জন্য ইতোমধ্যে শ্রমিক-মালিকদের মধ্যে ১৮ দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। আশা করা যায় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম এই খাতে ফিরে আসবে শৃংখলা।

খ.৪: সংখ্যালঘু ইস্যু নিয়ন্ত্রন: পতিত সরকার ক্ষমতা হারিয়ে ভারতে পালিয়ে যায় কিন্তু তার দোষররা ঘাপটি মেরে প্রশাসনের বিভিন্ন যায়গায় অবস্থান করছে। তারা এই সরকারকে ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর অংশ হিসেবে তারা বেছে নেয় পুরাতন অস্ত্র সংখ্যালঘু নির্যাতন। সাংখ্যালঘু ইস্যূ অনেকটাই রাজনৈতিক এবং কুটকৌশল। তারা নিজেরাই নিজেদের মন্দিরে ভাংচুর, হামলা, অগ্নিসংযোগ করে অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। ছাত্র-জনতা তাদের এই কুটকৌশল বুঝতে পেরে নিজেরাই মন্দির পাহাড়া দেয় ফলে সংখ্যালঘু ইস্যু নিয়ে তারা আর মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারেনি। এ ছাড়াও শিক্ষা ব্যবস্থায় পূর্বের বিতর্কিত ও বহুল সমালোচিত কারিকুলাম বাতিল, হজ্বের খরচ ১ লক্ষ টাকা কমানো, কালো টাকা সাদা করার বিধান বাতিল, সরকারি চাকুরীতে প্রবেশের বয়স ৩২ করা, জ্বালানি তেলের মূল্যা কমানো, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম না বাড়ানো ইত্যাদি বিষয়ে সফলতা লক্ষ্যনীয়।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যর্থতা:
গ.১: দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি নিয়ন্ত্রন করতে না পারা: আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ এত রাজনীতি বুঝেনা। তারা চাই দুবেলা পেট পুরে খেতে। বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের যে উর্ধগতি তা মানুষের নাগালের একেবারে বাইরে। সরকার কোন ভাবেই নিত্য পন্যের দাম কমাতে পারছেন না। ফলে সাধারন মানুষের নাবিশ্বাস উঠে গেছে। কোন ভাবেই সাধারণ মানুষ আয়-ব্যয়ের হিসাব মিলাতে পারছেন না। বর্তমান সরকার যদি এখনি দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে না ধরতে পারেন তাহলে অবশ্যই বিতর্কিত হবেন।

গ.২: বাজার সিন্ডিকেট ভাংতে না পারা: বাজার সিন্ডিকেট বাজার সিন্ডিকেট কথাটি আমরা শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই সিন্ডিকেটের কারণে বাজারের এই অবস্থা। তাহলে বাজার সিন্ডিকেট কেন সরকার ভাংতে পারছেনা। পতির সরকারের দোষররা যদি এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রন করে থাকে তাহলে অবশ্যই তাদেরকে চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় নিয়ে আনতে হবে।

গ.৩: বিতর্কিত লোকদের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দান: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আর একটি ব্যর্থতা হচ্ছে বিতর্কিত লোকদের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দান। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে পরামর্শের ভিত্তিতে উপদেষ্টা নিয়োগ দিলে এ প্রশ্ন হয়তো উঠতো না।

গ. ৪: সংস্কর কার্যক্রমে এখনো দৃশ্যমান অগ্রগতি না হওয়া: বৈশম্য দূর করার জন্য যে সংস্কার প্রয়োজন তা এই সরকার এখনো দৃশ্যমান করতে ব্যর্থ হয়েছে। সকল সংস্কার এই সরকার করতে পারবে না। তাই সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যে সংস্কার গুলো বেশি জরুরি তা করা দরকার। যেমন- নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ ও প্রশাসনিক সংস্কার ইত্যাদি। দ্রুত সময়ের মধ্যে এই সংস্কার গুলো করে নির্বাচন দেয়া প্রয়োজন। কেননা নির্বাচিত সরকার না হলে সকল প্রকার সংস্কার সম্ভব না।

গ.৫: বিচার বিভাগকে দ্রুততম সময়ে বাকশাল মুক্ত করতে না পারা: আমরা দেখতে পেলাম যে, এই সরকারকে ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য জুডিসিয়াল ক্যু করার অপচেষ্টা করা হয়েছিল। তার পরেও বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিচার বিভাগকে এখনও পুরোপুরি বাকশাল মুক্ত করতে পারেনি। যা সরকারের জন্য হুমকি স্বরুপ।

ঘ. এই মুহুর্তে সরকারের নিকট জনগনের প্রত্যাশা:
 দ্রুততম সময়ের মধ্যে দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে ধরা।
 বাজার সিন্ডিকেট ভেঙ্গে ফেলা।
 দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা।
 পতিত সরকারের চিহ্নিত অপরাধীদের দ্রত সময়ের মধ্যে গ্রেফতার করে শাস্তি নিশ্চিত করা।
 নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ ঘোষনা করা।
 দূর্নীতি দূর করে নাগরিক অধিকার সমূহ নিশ্চিত করা।
 রাজনৈতিক দলের সাথে পরামর্শ করে সংস্কার চূড়ান্ত করা।
 ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা দূর করে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা।
 পুলিশ বাহিনীকে সক্রিয় করে চুড়ি, ডাকাতি, ছিনতাই ইত্যাদি দূর করা।

ঘ. শেষকথা: শত শহীদের রক্ত বন্যার মধ্য দিয়ে যে দ্বিতীয় স্বাধীনতা আমরা অর্জন করেছি তা যদি হেলায় হারিয়ে ফেলি তাহলে দীর্ঘ সময়ের জন্য আমরা হারিয়ে যাব। বৈষম্যহীন রাষ্ট্র বিনির্মানের যে স্বপ্ন নিয়ে আমাদের সন্তানরা পিচঢালা পথ রক্তে রঙিন করেছে তা অবশ্যই সরকার এবং রাজনৈতিক দল গুলোকে বুকে ধারণ করতে হবে। আমাদের প্রিয় জন্মভূমিকে খাবলে খাওয়ার জন্য শকুনেরা এখনও তৎপর। এখন দরকার ইস্পাত কঠিন ঐক্য। বাঙালী বিরের জাতি ‘৫২, ‘৭১, ‘৯০ থেকে ‘২৪ তা প্রমানিত হয়েছে। আর যেন কোন স্বৈরশাসক জাতির ঘাড়ে জগদ্দাল পাথরের মতো চেপে বসতে না পারে সে দিকে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিকট জাতির প্রত্যাশা অযথা কালক্ষেপন নয়, আবার তাড়াহুড়াও নয়। যৌক্তিক সময় নিয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করুন।

লেখক শিক্ষক ও কবিঃ আব্দুর রাজ্জাক রিপন, সহকারি শিক্ষক (কম্পি.), মসজিদ-ই-নূর দাখিল মাদ্রাসা, রাজশাহী।